
বায়ুদূষণযুক্ত শহরে বাস করলে মানুষের হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং তা সহজেই ভেঙে যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চার হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করে স্পেনের বার্সেলোনার গবেষকরা অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তারা বলেছেন, যারা বেশি মাত্রায় বিষাক্ত বায়ুতে শ্বাসগ্রহণ করেন তাদের স্পাইন (মেরুদণ্ড) ও হিপের (কটি বা উরুর অস্থি ও মধ্য শরীরের সংযোগ স্থান) হাড়ে ঘনত্ব কম থাকে।
স্পেনিশ গবেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্রতর দূষিত বস্তু কণা শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে গিয়ে তা রক্তে মিশে হাড়কে দুর্বল করে দেয় এবং শরীরে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ের মধ্যে বয়ষ্ক ছাপ ফেলে দেয়। এছাড়া বায়ুদূষণ শরীরের প্যারাথাইরয়েড হরমোন নিঃসরণও কমিয়ে দেয়। প্যারাথাইরয়েড হরমোন শরীরে ক্যালসিয়াম নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে আসার কারণে হাড়ের ভঙ্গুরতা বেড়ে যায়।
বায়ুদূষণে সৃষ্ট ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন শহরে মানুষের ব্রেইন স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি ও ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে বলে গবেষণায় প্রমাণিত। তবে এসব নিয়ে সর্বশেষ বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল হেলথ ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এক গবেষণা চালিয়েছে তিন হাজার ৭০০ মানুষের ওপর। দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরের বাইরে ২৮ গ্রামের বাসিন্দার ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষকরা প্রতিটি গ্রামের বাতাসে ব্ল্যাক কার্বন ও পার্টিক্যাল ম্যাটার ২.৫ (পিএম২.৫) পরিমাপ করেন উপরোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
পিএম২.৫ হচ্ছে সবচেয়ে সুক্ষ্ম ধাতব কণা এবং ব্ল্যাক কার্বন সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থ। এই দুটো পদার্থই আসে পেট্রোল এবং ডিজেলচালিত গাড়ির ধোঁয়া থেকে। গবেষকরা হায়দ্রাবাদের ওই এলাকার প্রতি ঘন মিটার এলাকায় ৩৩ মাইক্রোগ্রাম পিএম২.৫ পেয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসারে, প্রতি ঘন মিটার এলাকায় সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম২.৫ থাকতে পারে। ওই শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইনের চেয়ে প্রতি ঘন মিটার বায়ুতে ২৩ মাইক্রোগ্রাম বেশি পিএম২.৫ পেয়েছেন গবেষকরা। ঠিক একই রকম বায়ুতে লন্ডনে পিএম২.৫ থাকে ১৩ মাইক্রোগ্রাম, নিউইয়র্কে থাকে ১২ মাইক্রোগ্রাম এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থাকে ১০ মাইক্রোগ্রাম।
গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ঠিক এই পরিমাণ পিএম২.৫ ভারী বস্তু কণা শরীরের পেছনের দিকে হিপ ও লাম্বার স্পাইনের ভেতরের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। তারা বলছেন, প্রতি তিন মাইক্রোগ্রাম পিএম২.৫ বাড়লে স্পাইনের হাড়ের ঘনত্ব কমে -০.৫৭ গ্রাম এবং হিপের হাড়ের ঘনত্ব কমে -০.১৩ গ্রাম। তারা বলছেন, এক মাইক্রোগ্রাম কার্বন বৃদ্ধি পেলে স্পাইনের হাড়ে ঘনত্ব কমে -১.১৩ গ্রাম এবং হিপের হাড়ে ঘনত্ব কমে -০.৩৫ গ্রাম করে।
এ গবেষণার প্রধান গবেষক অটাভিও র্যানজানি বলেন, ‘বায়ুদূষণে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও ইনফ্লামেশনের কারণে হাড়ের ঘনত্ব কমছে।’ এ গবেষণাটি জামা নেটওয়ার্ক নামক মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং গত ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইন।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বায়ুদূষণ কীভাবে প্যারাথাইরয়েড হরমোনে প্রভাব ফেলে এবং এই প্যারাথাইরয়েড হরমোন শরীরে ক্যালসিয়াম উৎপাদন কমিয়ে হাড়কে দুর্বল করে দেয়। তারা গবেষণায় দেখিয়েছেন বাতাসের মধ্যে থাকা পিএম২.৫-এর কারণে মানুষকে কীভাবে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে।
গবেষকরা বলেন, বিশ্বের ৮০ শতাংশেরও বেশি শহুরে মানুষ অনিরাপদ বায়ুদূষণের মধ্যে শ্বাসগ্রহণ করে। এটাকে তারা অদৃশ্য ঘাতক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়ে থাকে। বায়ুদূষণে আলঝেইমারস ও ডিমেনশিয়ার মতো রোগও হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বায়ুদূষণ শিক্ষার্থীদের অনুধাবন ক্ষমতায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বায়ুদূষণের কারণে নির্গত পদার্থগুলো ব্রেনে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে যানবাহন ও শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধাতব বস্তুর ক্ষুদ্রতর কণা ব্রেনে প্রবেশ করে অসুস্থতা তৈরি করে এবং ব্রেনের কার্যকারিতাও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
বায়ুদূষণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিশুরা অনেক বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে। সিনসিনাতি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বায়ুদূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের কাঠামোতে পরিবর্তন আনে। এ কারণে শিশুরা অনেক বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগে। দূষণ শিশুদের জীবনকালও কমিয়ে দেয়। বায়ুদূষণের কারণে এখনকার শিশুদের জীবনকাল দুই বছর হারিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ২০১৯ সালের এপ্রিলে এ গবেষণাটি করেছিল। শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় বায়ুদূষণ। অস্ট্রেলিয়ার মনাস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানান, সাংহাইয়ের উচ্চ দূষণযুক্ত এলাকার শিশুদের ৮৬ শতাংশের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। উচ্চ বায়ুদূষণের মধ্যে বড় হওয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বায়ুদূষণের মধ্যে বড় হওয়া শিশুরা হাঁপানিতে ভোগে বেশি। তারা বিশ্বব্যাপী ৪০ লাখ শিশুর মধ্যে গবেষণায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তারা আবার জানিয়েছেন, দূষণে বড় হওয়া শিশুদের ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা দেখিয়েছেন, উচ্চ হারে দূষিত বায়ুতে বেড়ে ওঠা শিশুরা নির্মল বায়ুর শিশুদের চেয়ে বেশি স্থূলকায় হয়ে থাকে। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড খাদ্যে থাকা চর্বি পোড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চর্বি পোড়াতে না পারলে তা শরীরে জমা হয়ে শিশু মোটা হয়ে যায়। ইউটাহ ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখিয়েছেন, বায়ুদূষণ গর্ভবতী মায়েদের ১৬ শতাংশ গর্ভপাত হওযার কারণ। ইউনিভার্সিটি অব স্টারলিংয়ের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, বায়ুদূষণে বসবাস করে এমন প্রতি এক হাজার মহিলার মধ্যে একজন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যানবাহনের ধোঁয়া মহিলাদের বিআরসিএ নামক জিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই জিন শরীরে টিউমার উৎপাদনে বাধা দেয়। টিউমার উৎপাদনে বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ায়, সেখান থেকে ক্যান্সারে পরিণত হচ্ছে। আবার বায়ুদূষণ পুরুষের শুক্রাণুর পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা ছাড়াও পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দিচ্ছে বায়ুদূষণ।